Hi

ঢাকা ০৮:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাগুরার জিআই সনদ পাওয়া হাজরাপুরী লিচু ঘিরে ৩০ গ্রামে এখন ব্যস্ত সময়

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:১৭:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • ১৫ Time View

মোঃ সাকিব খান মাগুরা জেলা প্রতিনিধি বাজারে আসতে শুরু করেছে হাজরাপুরী লিচু। প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ২০০-৫০০ টাকায়। লিচুগাছে ফুল আসার পর থেকেই বাগানের পরিচর্যা শুরু হয়। এ সময়ে বাড়ির সবাই মিলে লিচু নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এখন বাগান থেকে লিচু সংগ্রহ করে বিক্রি করা শুরু হয়েছে। লিচুর বাগান থেকে যে টাকা আসবে, তাতে ছয় মাসের সংসার চলে। অন্য কোনো ফসল চাষ করে একবারে এত নগদ অর্থ পাওয়া যায় না।’ এসব কথা বলছিলেন মাগুরা সদর উপজেলার রাওতড়া গ্রামের বাবুল কুমার বিশ্বাস। সদর উপজেলার হাজরাপুর ও হাজীপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা এখন লিচুবাগান ঘিরে। গতকাল রোববার গিয়ে দেখা যায়, কেউ গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন, কেউ তলায় বসে বাঁধছেন। কেউ আবার তা ঝুড়িতে ভরছেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, মাগুরায় দুই ধরনের লিচুর আবাদ হয়, যার একটি স্থানীয় জাত হাজরাপুরী লিচু, অন্যটি বিদেশি জাত ‘বোম্বাই’। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের যে নতুন ২৪টি পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ দিয়েছে, তার মধ্যে একটি মাগুরার হাজরাপুরী লিচু। গত ৩০ এপ্রিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর আয়োজিত বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের আলোচনা সভায় মাগুরার জেলা প্রশাসকের কাছে এ সনদ হস্তান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই স্বীকৃতি পাওয়ায় বাজারে মাগুরার স্থানীয় এ জাতের লিচুর চাহিদা বাড়বে। হাজরাপুরী লিচুর ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে সদর উপজেলার হাজরাপুরে ছিল একটি নীলকুঠি। সেই নীলকুঠিতে প্রথমবার কয়েকটি লিচু চারা এনে রোপণ করেছিলেন নীল চাষ তদারকিতে থাকা ব্যক্তিরা। পরে ওই গাছ থেকে কলম করে লিচুর জাত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হাজরাপুর ও এর আশেপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে লিচু চাষ শুরু হয় ৩০-৪০ বছর আগে। মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর জেলায় ৬৬৯ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। তবে শুধু সদর উপজেলাতেই ৫৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া শালিখায় ৪৩, শ্রীপুরে ৩৭ ও মহম্মদপুরে ৫৮ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান করেছেন চাষিরা। এবার জেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। স্থানীয় চাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিস–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজরাপুরী লিচুর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। এই লিচু দেশের অন্যান্য এলাকার লিচুর তুলনায় আগে পাকে ও বাজারে আসে। হাজরাপুরী লিচুর রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। এ ছাড়া এই লিচু টসটসে, রসে ভরপুর। হাজরাপুর গ্রামের বাসিন্দা শিবুপদ দত্ত (৬১) বলেন, ‘অন্য অনেক এলাকার লিচু আছে দেখতে বড়, কিন্তু খেতে গেলে স্বাদ তালের শ্বাসের মতো। আর আমাদের হাজরাপুরী লিচু আসল স্বাদ দেবে। আমাদের এই এলাকায় এমন কোনো বাড়ি পাবেন না, যে বাড়িতে একটিও লিচুগাছ নেই। এই লিচুর ওপর আমাদের এলাকার অনেক মানুষ নির্ভরশীল।’ স্থানীয় চাষি ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, জিআই সনদ পাওয়ায় হাজরাপুরী লিচুর কদর বাড়বে। গত বছর এ সময়ে হাজরাপুরী লিচু প্রতি হাজার পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। এবার সেখানে মৌসুমের শুরুতে এই লিচু বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। জিআই সনদ পাওয়ায় এই লিচুর উৎপাদন থেকে বিপণনের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার কথা বলছে স্থানীয় প্রশাসন। এর অংশ হিসেবে গতকাল ইছাখাদা এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে লিচু সংগ্রহের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সদর উপজেলা প্রশাসন। এর পাশাপাশি ইছাখদা পুরাতন বাজার এলাকায় লিচু মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যান্ডিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং রপ্তানির জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এর পাশপাশি গবেষণা, প্রশিক্ষণ, কৃষকদের সংগঠন গঠন ও উন্নত জাত সংরক্ষণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম বলেন, হাজরাপুরী লিচুর ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন লাভ মাগুরাবাসীর জন্য গর্বের। একই সঙ্গে কৃষকদের জন্য সম্ভাবনাময় একটি মাইলফলক। জিআই সনদ একটি পণ্যের স্বাতন্ত্র্য ও গুণগত মানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে হাজরাপুরী লিচুর বাজারমূল্য ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, কৃষকের আয় বাড়বে। দেশের বাইরের বাজারেও রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

পুটিজানা ইউনিয়নের তামালতলা বাজারে ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় হাডুডু ও রশি টানাটানি খেলা অনুষ্ঠিত

মাগুরার জিআই সনদ পাওয়া হাজরাপুরী লিচু ঘিরে ৩০ গ্রামে এখন ব্যস্ত সময়

Update Time : ০৪:১৭:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

মোঃ সাকিব খান মাগুরা জেলা প্রতিনিধি বাজারে আসতে শুরু করেছে হাজরাপুরী লিচু। প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ২০০-৫০০ টাকায়। লিচুগাছে ফুল আসার পর থেকেই বাগানের পরিচর্যা শুরু হয়। এ সময়ে বাড়ির সবাই মিলে লিচু নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এখন বাগান থেকে লিচু সংগ্রহ করে বিক্রি করা শুরু হয়েছে। লিচুর বাগান থেকে যে টাকা আসবে, তাতে ছয় মাসের সংসার চলে। অন্য কোনো ফসল চাষ করে একবারে এত নগদ অর্থ পাওয়া যায় না।’ এসব কথা বলছিলেন মাগুরা সদর উপজেলার রাওতড়া গ্রামের বাবুল কুমার বিশ্বাস। সদর উপজেলার হাজরাপুর ও হাজীপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা এখন লিচুবাগান ঘিরে। গতকাল রোববার গিয়ে দেখা যায়, কেউ গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন, কেউ তলায় বসে বাঁধছেন। কেউ আবার তা ঝুড়িতে ভরছেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, মাগুরায় দুই ধরনের লিচুর আবাদ হয়, যার একটি স্থানীয় জাত হাজরাপুরী লিচু, অন্যটি বিদেশি জাত ‘বোম্বাই’। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের যে নতুন ২৪টি পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ দিয়েছে, তার মধ্যে একটি মাগুরার হাজরাপুরী লিচু। গত ৩০ এপ্রিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর আয়োজিত বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের আলোচনা সভায় মাগুরার জেলা প্রশাসকের কাছে এ সনদ হস্তান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই স্বীকৃতি পাওয়ায় বাজারে মাগুরার স্থানীয় এ জাতের লিচুর চাহিদা বাড়বে। হাজরাপুরী লিচুর ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে সদর উপজেলার হাজরাপুরে ছিল একটি নীলকুঠি। সেই নীলকুঠিতে প্রথমবার কয়েকটি লিচু চারা এনে রোপণ করেছিলেন নীল চাষ তদারকিতে থাকা ব্যক্তিরা। পরে ওই গাছ থেকে কলম করে লিচুর জাত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হাজরাপুর ও এর আশেপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে লিচু চাষ শুরু হয় ৩০-৪০ বছর আগে। মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর জেলায় ৬৬৯ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। তবে শুধু সদর উপজেলাতেই ৫৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া শালিখায় ৪৩, শ্রীপুরে ৩৭ ও মহম্মদপুরে ৫৮ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান করেছেন চাষিরা। এবার জেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। স্থানীয় চাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিস–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজরাপুরী লিচুর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। এই লিচু দেশের অন্যান্য এলাকার লিচুর তুলনায় আগে পাকে ও বাজারে আসে। হাজরাপুরী লিচুর রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। এ ছাড়া এই লিচু টসটসে, রসে ভরপুর। হাজরাপুর গ্রামের বাসিন্দা শিবুপদ দত্ত (৬১) বলেন, ‘অন্য অনেক এলাকার লিচু আছে দেখতে বড়, কিন্তু খেতে গেলে স্বাদ তালের শ্বাসের মতো। আর আমাদের হাজরাপুরী লিচু আসল স্বাদ দেবে। আমাদের এই এলাকায় এমন কোনো বাড়ি পাবেন না, যে বাড়িতে একটিও লিচুগাছ নেই। এই লিচুর ওপর আমাদের এলাকার অনেক মানুষ নির্ভরশীল।’ স্থানীয় চাষি ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, জিআই সনদ পাওয়ায় হাজরাপুরী লিচুর কদর বাড়বে। গত বছর এ সময়ে হাজরাপুরী লিচু প্রতি হাজার পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। এবার সেখানে মৌসুমের শুরুতে এই লিচু বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। জিআই সনদ পাওয়ায় এই লিচুর উৎপাদন থেকে বিপণনের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার কথা বলছে স্থানীয় প্রশাসন। এর অংশ হিসেবে গতকাল ইছাখাদা এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে লিচু সংগ্রহের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সদর উপজেলা প্রশাসন। এর পাশাপাশি ইছাখদা পুরাতন বাজার এলাকায় লিচু মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যান্ডিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং রপ্তানির জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এর পাশপাশি গবেষণা, প্রশিক্ষণ, কৃষকদের সংগঠন গঠন ও উন্নত জাত সংরক্ষণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম বলেন, হাজরাপুরী লিচুর ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন লাভ মাগুরাবাসীর জন্য গর্বের। একই সঙ্গে কৃষকদের জন্য সম্ভাবনাময় একটি মাইলফলক। জিআই সনদ একটি পণ্যের স্বাতন্ত্র্য ও গুণগত মানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে হাজরাপুরী লিচুর বাজারমূল্য ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, কৃষকের আয় বাড়বে। দেশের বাইরের বাজারেও রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।